আজ || রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫
শিরোনাম :
  গোপালপুরে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা       ধনবাড়ি মডেল প্রেসক্লাবে সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদ ও দোয়া       গোপালপুরে মরহুম আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট       টাঙ্গাইল-২ আসনে গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থী শাকিল উজ্জামান       গোপালপুরে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ       গোপালপুরে শিক্ষার্থীদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করেন সালাম পিন্টু       গোপালপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ছাত্রদলের বিক্ষোভ       গোপালপুরে যথাযোগ্য মর্যাদায় জুলাই শহীদ দিবস পালিত       গোপালপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল       গোপালপুরে প্রতিপক্ষের হামলায় ১২ মামলার আসামি চাকমা জাহাঙ্গীর নিহত    
 


একুশ কথা বলো

Photo 21 Feb 2015

অধ্যাপক ড. শেখ জিনাত আলী

খ্রীষ্টীয় বর্ষের একুশে ফেব্রুয়ারি সমাগত। তথ্যান্তরে এই দিনটি ৮ ফাল্গুন যা আমাদের সাহিত্য-সং¯ৃ‹তি জগতে কোন লেখনিতে উল্লেখ দেখি না। দিবসটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে। একুশ মানে মাথানত না করা। একুশ বাঙালি জাতিসত্ত্বার জন্ম দিল বাংলার কতিপয় দামাল সন্তানের আত্মহুতির মাধ্যমে। একুশ বাংলার মাটিকে করেছে ধন্য-পবিত্র। ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দের ২১ থেকে কত বছর আমরা পেরিয়ে এসেছি তা যে কেউ হিসেব করে দেখতে পারেন। এই বছরগুলোতে আমাদের শহীদদের রক্তের ঋণ আমরা আজও শোধ করতে পারিনি, অথচ আমাদের অর্জন তো কম নয়। একটি মুক্তিযুদ্ধ ও এর মাধ্যমে বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামের একটি দেশ ১৯৭১ খ্রীস্টাব্দে অর্জন আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। বাঙালি হাজার বছরের অনেক কন্টাককীর্ণ পথ হেটে স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ অর্জন করেছে এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করে একটি রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে নিজেদের গড়ে তোলার-বিকশিত করার রাস্তা পেয়েছে। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দেশগুলোর (তৎকালীন সোভিয়েত হউনিয়ন ও ভারত সহ) প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আমরা সে পথে হাটতে চেয়েছিলাম এবং কাজও শুরু করেছিলাম। কিন্তু ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতারোহন খন্দকার মোশতাক ও অন্য কতিপয় ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যক্ষ মদদে আমাদেরকে সেই পথ থেকে সরিয়ে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, যে ধারা দ্বিজাতিতত্ব তথা সাম্প্রদায়কতা-শোষণ থেকে আমরা এখনো বের হয়ে আসতে পারি না। পৃথিবীর আর কোন জাতি ভাষার জন্য রক্ত ঝরায় নি। ছয় হাজার- এর বেশি ভাষা পৃথিবীতে থাকার তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক ভাষা মরে গেছে ইতোমধ্যে।

প্রায় ১৫ বছর পাকিস্তানি ধারার শাসন চলেছে জিয়া- এরশাদ শাসন কালে। অতঃপর ১৯৯০ অবধি এই শাসনে সংবিধান সামরিক ফরমান বলে সংশোধন করে দেশটি শাসিত হয়েছে যদিও সামরিক শাসকদ্বয় পছন্দমত লোকদের দিয়ে জাতীয় সংসদ গঠন করে ফর্রমানগুলো অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ পক্ষ শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে এসব সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে গেছে সামরিক স্বৈরাচারদ্বয়ের ডান্ডার মুখে। বাঙালি ও পাহাড়ি নৃ-জাতিত্বর বিভাজন মুছে দেয়ার সবরকম করণীয় করে গেছেন তারা। এখানে একটি ভ্রান্ত ধারণার প্রসঙ্গঁ উল্লেখ্য জাতিগঠন প্রসঙ্গেঁ। শুধু ভাষা জাতি গঠনের একমাত্র উপাদান নয়। আর ধর্ম তো কোনক্রমেই জাতিগঠনে ভূমিকা রাখে না। জাতিগঠনে কৌললতিকা প্রধান উপাদান ও ভিত্তি বিভিন্ন ভৌগোলিক পরিমন্ডলের মধ্যে এর সিথস্ক্রিয়া ঘটে বলে বর্ণে-মননে-গঠনে বিভিন্নতা সৃষ্টি হয়। এ সব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমাদের সমাজে অনুপস্থিত এবং আমাদের মত অন্যান্যদের মধ্যেও। কাজেই এখানে ইচ্ছা করলেই জাতি বানানো যায় না। আমাদের জাতিসত্ত্বা এই অঞ্চলের (ভারত বর্ষে) সকল জাতির বেলায় প্রযোজ্য। পাকিস্তানিজাতি তাই মিথ্যা ও কৃত্রিম। শুধু ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি করা হয় বাঙালিকে ও অন্য পাহাড়ি নৃ-জাত দাবিয়ে রেখে শোষণটা পাকাপোক্ত করার জন্য। এই সামগ্রিক শ্যনিচক্র থেকে বের করে আনার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি সেই ১৬ ডিসেম্বর থেকেই সচেষ্ট ছিল এবং ১৯৭৫-র ১৫ আগষ্ট হিংসাত্মক ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর একটি বড় ধাক্কা এলো রাজনীতিকদের ওপর। প্রথম থেকে এটাকে শুধুমাত্র একটি অভুতপূর্ব হিংসাত্মক বিয়োগান্ত ঘটনাই নয় বলে রাজনীতিকরা ভাবতে থাকেন এবং বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা একটি আদর্শিক যুদ্ধই চাপিয়ে দেয় গোটা জাতির ললাটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে। চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পালটে দেয়া হয় জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় আরোহরন করলে।

এ লড়াই নানা কৌশলে-কায়দায় চলতে থাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭৬-৭৭ পরবর্তী সময় কালে। চলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বা দলগুলোর মধ্যে বিভাজন, কেউ জিয়ার ১৮-দফার প্রতি সরাসরি সমর্থন জানায়, আবার তথাকথিত হাঁ-না ভোটে অংশ গ্রহণ করে জিয়াকে রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতি থেকে নিভৃত করার ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। আর এক দিকে জামাত-ই-ইসলামসহ সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে রাজনীতিকে পূর্ণবাসন করে চলেন জেনারেল জিয়া, সামরিক বাহিনীতে ১৮-১৯টি ক্যুদ্যতা চালানো হয়, অসংখ্যা মুক্তিযোদ্ধা দেশপ্রেমিক সৈনিককে হত্যা করা হয় সামরিক আদালতে গোপনে বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে। ওদিকে ১৯৭৫র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের তৎকালীন নব্যপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের যুদ্ধবিধস্ত অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টায় কাজ করার মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্তায় জাসদ-সিরাজ শিকদার-যপ্টিমেরে থাকা পরাজিত দলগুলোর একযোগে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা রোধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের এক প্রয়াস পান। গঠন করেন সবদলের সহযোগে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। সবদল নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর নিয়ন্ত্রন নেমে আসে পরবর্তীকালে গণতন্ত্র হত্যা নামে উহা বিরোধী মহল প্রচারণা চালায় এবং আজও তা উচ্চারণ করা হয় শোষণের সৃগ্রয়াক্ষেত্র তৈরির অগচেষ্টায়। বাকশাল বাস্তবায়নের আগেই বঙ্গঁবন্ধুকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবনে। এর পর ১৫ বৎসর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ধারায় দেশ শাসিত হয় জিয়া- এরশাদের সামরিক শাসনে। গঠন করা হয় সামরিক ছাউনিতে রাজনৈতিক দল গঠনের এক মহাযঞ্জ। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভূত চেপেবসে বাংলার মানুষের উপর জিয়ার নেতৃত্বে, যা বেনামে মুসলিম লীগ, একটি পাঁচ মিশালি দল। এই অবস্থায় ১৯৮১র ৩০মে জিয়াকে চট্রগ্রামের সার্কিট হাউজে একদল মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা করে। ক্ষমতায় আধিষ্ঠিত হয় সেনা প্রধান অমুক্তিযোদ্ধা জেনারেল এরশাদ। খুন হন প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর অভ্যুৎমান ঘটানোর অভিযোগে। প্রথমবার অমুক্তিযোদ্ধা সেনাপতি হলেন জেনারেণ হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ। ‘বিসমিল্লাহ’ দিয়ে সংবিধান করেন জেনারেল জিয়া, আর রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম সংযোজন করেন জেনারেল এরশাদ এবং জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণে জাতীয় পার্টি নামের আর একদল গঠন করেন সেনা ছাউনিতে। অপরিবর্তিত থাকলো দেশের নাম, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত। আর অগণিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির জন্য রয়েগেল শহীদ মিনার ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত।

আমি শহীদ মিনারকে বার বার নিয়ে আসি এই মুহুর্তে আমার দেশমাতৃকায় যা ঘটছে ৪৫ দিনে (৬৬৪ গাড়ী পুড়িয়ে ৯০ জন হত্যা করা হয়েছে) তাকে প্রতিরোধ করার শক্তি পেতে, সহিংসতা-সম্পদ ধ্বংসাবন্ধ করার প্রেরণা পেতে। আমি শহীদ দিবসকে চিরদিন স্মরণ করি, বাঙালি বলে যারা পরিচয় পেতে চান তাদের সবাইকে স্মরণ করতে বলি প্রতিদিন কাজে-কর্মে, চিন্তা-চেতনায়, মাঠে-ময়দানে, শিক্ষা-দীক্ষায়-সংস্কৃতি চর্চায়। যতবার এই বাংলার মাটিতে হায়নার থাবা পড়েছে অভ্যন্তর থেকে বা বহিরাঙ্গন থেকে ততবার আমরা তা প্রতিরোধে শহীদমিনারে একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুস্পস্তবকে শক্তি সঞ্চয় করেছি, এবার অন্য মাত্রায় একুশে উদযাপন করতে চাই। একুশ তুমি কথা বলো পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে যারা অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করছে তাদের রক্ষায়। আমার অন্তরের সমস্ত আকুতিতে এই ধ্বংসযাজ্ঞ মানুষকে পুড়িয়ে মারার কাজে যে সব জঙ্গি-জড়িত দেখছি দূরদর্শন পর্দায় তাদের ধ্বংস করা ছাড়া আমাদের কোন বিকল্প নেই। দূরবৃত্ত অসুরদের সাথে যারা সংলাপ করতে ইনিয়েবিনিয়ে কথার মারপ্যাচে পরামর্শ দিতে উড়ে আসছেন তাদের বলতে চাই আপনারা নিজের চড়কায় তেল দেন। রাজনীতি এটা নয়। এটা নিছক সন্ত্রাসীকর্ম। সন্ত্রাসকে সন্ত্রাস দিয়ে মোকাবেলা করার কথা বলছি না, বলবোনা কোন দিন। কিন্তু আইন-শৃংখলা বাহিনীর কাজকে যারা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলছেন তারা যে মতলববাজ সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ কেউ যেন কখনও অন্তরে পোষণ না করেন সেই অনুরোধটাই করতে চাই। আড়ালে আবডালে থেকে অবরোধ-হরতালের ডাক দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন যারা একুশ তুমি তাদের নিবৃত করো এই মুহুর্তে, এক্ষণই। একুশ কথা বলো, কথা বলো, বাংলার মানুষকে সাহস-শক্তি যোগ্যও সকল হীনমন্যতা ও কালিমা দুর করতে। একুশে ফেব্রুয়ারি যা ছিল তখন ৮ ফাল্গুন আমার একান্তজন। তাকে স্মরণ করি চলমান সহিংসতা ও সন্ত্রাস বন্ধের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ এর ডাক দিয়ে। অমর একুশে অমর থাক।

লেখক : অধ্যাপক, লেখক।

মন্তব্য করুন -


Top
error: Content is protected !!